প্রফেসর মোহাম্মদ আলী
প্রফেসর মোহাম্মোদ আলীর পিতা-মুন্সী মোহাম্মদ সানাউল্লাহ (১৮৮৪-১৯৫৯) ছিলেন স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত। মাতা-আয়েশা খাতুন। প্রফেসর মোহাম্মোদ আলির জন্ম ১ ফেব্রুয়ারী , ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং এর যাত্রাপাশায় ।
প্রফেসর মোহাম্মোদ আলী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন পারিবারিক ভাবে । শৈশব কালেই তাঁর মধ্যে লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। পিতা আরবি শিক্ষিত হলেও আধুনিক শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন না। প্রথম দিকে ছেলেকে আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত করার চিন্তা ভাবনা করলেও পরে আধুনিক শিক্ষার প্রতি ছেলের আগ্রহ লক্ষ্য করে শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করেন। তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা লগ্নে সহি-শুদ্ধ ভাবে কোরান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে বানিয়াচং ১৪৬ নং রায়ের পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাসিক তিন টাকা হারে বৃত্তি লাভ করেন।

উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন ঐ বিদ্যালয়ের প্রথম বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি বানিয়াচং লোকনাথ রমান বিহারী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে আসাম প্রদেশিক সরকারের মাসিক বিশ টাকা প্রতিযোগিতামূলক বৃত্তি লাভ করেন।এটা ছিল ঐ হাই স্কুল থেকে প্রাপ্ত প্রতিযোগিতামূলক বৃত্তি। তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তাকে হরিশচন্দ্র রৌপ্যপদকে ভূষিত করেন।
ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম বিভাগে আই.এ এবং ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাস করেন। উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার প্রবল আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে লেখাপড়ায় সাময়িক ভাবে বিরতি দিয়ে বেসরকারী ও সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন কিন্তু তাঁর অদম্য স্পৃহার কাছে শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি নগণ্য চাকরি আকর্ষণ ছিন্ন করে ১৯৪৮-১৯৪৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হয়ে ১৯৫০ খ্রিঃ দর্শনশাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পুরস্কৃত হন। তিনি এম.এ পরীক্ষায় দুটি পেপারে যে মার্ক পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে কেউ সে রের্কড মার্ক পাননি।
শিক্ষা জীবন শেষ করেই তিনি নোয়াখালী চৌমোহনী কলেজে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। পরে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে চলে আসেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তখন মাত্র চারটি সরকারী কলেজে ছিল। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিলেট সরকারী এম.সি কলেজে যোগদান করেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পদোন্নয়নক্রমে আবার রাজশাহী সরকারী কলেজে বদলী হন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো সিলেট সরকারী কলেজে ( বর্তমানে এম.সি কলেজ ) যোগদান করেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে প্রেষণে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে হবিগঞ্জ সরজারী বৃন্দাবন কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। হবিগঞ্জ সরজারী বৃন্দাবন কলেজের কারনে পর তিনি প্রথম প্রিন্সিপাল। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারী চাকরী থেকে অবসর গ্রহন করেন।
সরকারী চাকরী থেকে অবসর গ্রহনের পর কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম কলেজে এবং কুমিল্লা মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঐ কলেজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বানিয়াচং শচীন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। উল্লেখ্য যে, প্রফেসর মোহাম্মদ আলি উক্ত কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম কলেজ ছাড়া বাকি তিনটি কলেজেরই প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন।
প্রফেসর মোহাম্মদ আলি ষাটের দশকে সাবেক পাকিস্তানের হায়েদ্রাবাদ এবং করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস এ যোগদান করে দর্শন শাস্ত্রের উপর মূল্যবান প্রবন্ধ পাঠ করেন। হায়দ্রাবাদ সম্মেলনের দলনেতা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও প্রফেসর মোহাম্মদ সাইদুর রহমান।
হবিগঞ্জ মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে তিনি জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ১৯৯০ এ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজে শিক্ষক নির্বাচিত হন এবং দশ হাজার টাকার পুরস্কার সহ সম্মান লাভ করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ৬ জানুয়ারী তাঁকে ‘মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ পুরষ্কার’ পদক প্রদান করা হয় একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। জাতীয় গ্রন্থ দিবস ও সপ্তাহ-৯৫, হবিগঞ্জ উপলক্ষে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারী তাঁকে সম্মানসূচক সনদপত্র প্রদান করা হয়। প্রফেসর মোহাম্মদ আলি ২৮শে এপ্রিল ২০০৩ সাকে ইন্তেকাল করেন।
হবিগঞ্জ নাগরিক কমিটি এমন একজন সাহিত্যঅনুরাগীকে সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছে। আজ এই সম্মাননা গ্রহন করবেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলির দ্বিতীয় সন্তান হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জাহানারা খাতুন।