ডাঃ সৈয়দ গোলাম রহিম
জন্ম-মৃত্যু : ১৮৮২-১৯৯২

বানিয়াচং-এর সৈয়দ গোলাম রহিম আনুমানিক ১৮৮২ইং সালে পীর মৌলভি সৈয়দ গোলাম সামদানি (রহঃ) সাহেবের ঔরষে ও দেওয়ান সালেহা খাতুন চৌধুরীর গর্ভে বানিয়াচং গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মীর মহল্লার (উত্তরগড় হাবিলী) এই সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । তাহার পূর্ব পুরুষ কুতুবুল আউলিয়া সৈয়দ ইলিয়াছ কুদ্দুছ (রহঃ) এর চতুর্থ পুত্র সৈয়দ শাহ বদর উদ্দিন (রহঃ) এর বংশধর । তিনি চির নিদ্রায় আছেন মুড়ারবন্দ দরবার শরীফে । উনার পিতা সৈয়দ কুতুবুল আউলিয়া মাজার শরীফের ভিতরে ডানদিকে প্রথম সারিতে শায়িত আছেন । মুড়ারবন্দ দরবার শরীফের মাজারগুলির নকশাতে উল্লেখ আছে সৈয়দ বদর উদ্দিন (রহঃ) এর মাজার । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম প্রাথমিক শিক্ষা ও হাই স্কুল শিক্ষা নিজ গ্রামেই শেষ করেন এবং সুনামের সাথে এন্ট্রাস পাশ করেন । উনার নানা স্নানঘাট নিবাসী দেওয়ান তমিজ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর আদেশে উনাকে কলকাতায় লেখাপড়া করিতে পাঠানো হয় । নানার আদেশে তিনি ডাক্তারি পড়া শুরু করেন এবং সুনামের সঙ্গে ডাক্তারি ডিগ্রি পরীক্ষা এল.এম.এফ. পাশ করেন । পাশ করার পরপরই তৎকালীন কলকাতায় উনাকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় । পরবর্তীতে তাঁকে সাবেক হবিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) আজমিরীগঞ্জ থানার কাকাইলছেও হেলথ সেন্টারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন । অবসর গ্রহনের পর তিনি স্থানীয় বানিয়াচং বড় বাজারে একটি চিকিৎসালয় গড়ে তুলেন । কিছুদিন তিনি সেখানে মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন । পরবর্তীতে ঐ চিকিৎসালয় নিজ বাড়িতে স্থানান্তর করেন । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম শুধুমাত্র একজন খ্যাতিমান ডাক্তারই ছিলেন না,তিনি একজন আধ্যাত্মিক কামেল,পীর ও বুজুর্গ ব্যক্তিও ছিলেন । তিনি হবিগঞ্জ জেলার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ জেলার ব্যাপক এলাকার আর্ত-পীড়িত মানুষের বিনামুল্ল্যে চিকিৎসা করতেন । তাঁর প্রতি সাধারন মানুষের এতো বেশি ভক্তি,স্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল যে,তিনি মানুষের গায়ে হাত বুলালে সব ধরনের রোগ দূর হয়ে যেত বলে শুনা যায় । তাঁর পুরো জীবনই তিনি সমাজ সেবা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যয় করেছেন । বলা বাহুল্য, ১৩৫০ বাংলা সনে বানিয়াচঙ্গে মরনঘাতী ম্যালেরিয়া রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় তিনি প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন । নিজ বাড়ির মহল্লায় জামে মসজিদে সুউচ্চ মিনার তৈরি করতে এবং মীর মহল্লা মক্তবখানা তৈরি করতে তিনি বিপুল পরিমান অর্থ দান করেন । আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশির বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি গোপনে অর্থ সাহায্য দান করতেন । নিজ বাড়িতে পুকুর খনন করে তিনি আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের গোসল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন । নিজ পাড়ায় বিশুদ্ধ পানির জন্য একটি নলকূপও বসিয়েছিলেন । এছাড়াও তাঁর আরো অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায় । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম প্রথম বিবাহ করেন তৎকালীন কলিকাতা নিবাসী বিখ্যাত মৌলভী সৈয়দ নওয়াব আলী সাহেবের কন্যা সৈয়দা খাইরুন নেছা-কে । মৌলভী সৈয়দ নওয়াব আলী সাহেব তৎকালীন দাউদনগর পরগণার বন্দেগীর সৈয়দ শাহ দাউদ (রহঃ)-এর বংশধর । সৈয়দা খাইরুন নেছার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বড় ছেলে সৈয়দ জাফর ইমাম ও বড় মেয়ে সৈয়দা আনোয়ারা বেগম । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম সাহেবের বড় ছেলে সৈয়দ জাফর ইমাম লেখাপড়া শেষ করে নিজ বাড়িতে মীরমহল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন । তিনি বিয়ে করেন কিশোরগঞ্জ জেলার বিখ্যাত বৈলাই সাহেব বাড়ির উর্দু কবি মহিউদ্দিন আহমদ (মাহমুদ বাঙালী)-র একমাত্র কন্যা মোছাঃ নুরুন্নাহার সালমা খাতুন চৌধুরানীকে । মোছাঃ নুরুন্নাহার সালমা খাতুন চৌধুরানী বিখ্যাত কবি মনির উদ্দিন ইউসুফ সাহেবের চাচাতো বোন । সৈয়দ জাফর ইমাম একজন পরোপকারী,দানশীল ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন । ধনী-গরিব সকলের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম ভালোবাসা । তিনি সবসময় প্রতিবেশি-আত্মীয়স্বজনের খোঁজ-খবর রাখতেন । যেকোনো বিপদে-আপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন । কথিত আছে যে,মহল্লার লোকেরা বলত তিনি খুব নম্র ও ভদ্র ভাবে কথা-বার্তা বলতেন । তাঁর অন্তর সুন্দর ছিল এবং তাঁর সদাচরণ ও মধুর বচন সকলেরই হৃদয় আকৃষ্ট করত । তিনি একজন ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়ও ছিলেন । মোছাঃ সালমা খাতুনের গর্ভে জন্মগ্রহন করেন একমাত্র ছেলে সৈয়দ মুজাফফর ইমাম (সাজ্জাদ) ও দুই মেয়ে সৈয়দা শামিমা আক্তার ও সৈয়দা ফাহিমা আক্তার । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিমের নাতি সৈয়দ মুজাফফর ইমাম (সাজ্জাদ) ব্যবসা ও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক প্রতিস্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন । যেমন-আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম,বানিয়াচং সাহিত্য পরিষদ,হবিগঞ্জ তরফ সাহিত্য পরিষদ ও একটি এন.জি.ও. (ইনসার্ফ) এবং লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতার কাজে নিয়োজিত আছেন । সৈয়দ মোজাফফর ইমাম বিয়ে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলার নুরপুর সৈয়দ বাড়ির মরহুম সৈয়দ আজিজুল হক (সাবেক তথ্য অফিসার,হবিগঞ্জ) সাহেবের বড় মেয়ে সৈয়দা নুজহাত তাসনুবা-কে । সৈয়দা নুজহাত তাসনুবার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে দুই ছেলে সৈয়দ নাজমুল ইমাম ও সৈয়দ মনজুরুল ইমাম । সৈয়দ মোজাফফর ইমাম বর্তমানে বসবাস করছেন হবিগঞ্জ শহরের অনন্তপুর আবাসিক এলাকায় । সৈয়দ জাফর ইমামের বড় মেয়ের বিবাহ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলার নরহা চৌধুরী বাড়ির আজিজুর রহমান চৌধুরীর সাথে এবং ছোট মেয়ের বিবাহ হয় কুমিল্লা জেলার দক্ষিন চরর্থা নওয়াব বাড়ির সৈয়দ তারেক আহমেদের সঙ্গে,তিনি সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকেন । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম সাহেবের মেয়ে সৈয়দা আনোয়ার বেগমের বিয়ে হয় আপন চাচাতো ভাই মৌলভী সৈয়দ গোলাম ছোবহানী সাহেবের সাথে । সৈয়দ ছোবহানী সাহেব একজন ব্যবসায়ী ছিলেন । তাদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে । ছেলেদের মধ্যে সৈয়দ গোলাম মুহিত,সৈয়দ গোলাম মুফিদ ও সৈয়দ গোলাম মাহমুদ বিভিন্ন ব্যবসা ও চাকুরীতে কর্মরত আছেন । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম দ্বিতীয় বিয়ে করেন হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমবাগ সৈয়দবাড়ি নিবাসী পীর সৈয়দ আব্দুল লতিফ সাহেবের কন্যা সৈয়দা সামছুন্নাহার বিবিকে । পীর সৈয়দ আব্দুল লতিফ সাহেবের পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাছিরনগর উপজেলার অন্তর্গত গোকর্ণজেটা গ্রামের সাহেব বাড়িতে । সৈয়দা সামছুন্নাহারের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ছোট ছেলে সৈয়দ গোলাম মুহিউদ্দিন ও ছোট মেয়ে সৈয়দা রাবেয়া খাতুন । সৈয়দ গোলাম মুহিউদ্দিন বহুদিন ধরে বানিয়াচং থানার বি.আর.ডি.বি. এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন । নিজ বাড়ি মীরমহল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মীরমহল্লা জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছেন । তিনি বিবাহ করেন চাচাতো বোন সৈয়দা সালেহা খাতুনকে । সৈয়দা সালেহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে আট ছেলে ও তিন মেয়ে । বড় ছেলে সৈয়দ মিজবাহ উদ্দিন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের  পৌর কমিশনার । সৈয়দ মইন উদ্দিন ব্যবসা করেন,সৈয়দ মুজাহিদ উদ্দিন গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি করেন,সৈয়দ মোকাম্মেল উদ্দিন শাহজালাল মাজার শরিফ ওয়ার্ডের কাজি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন । ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম সাহেবের তিন ভাই ও পাঁচ বোন । বড় ভাই পীর সৈয়দ গোলাম ইজদানী,দ্বিতীয় ভাই এল.আর. সরকারি হাই স্কুল,বানিয়াচং এর সাবেক হেড মৌলানা সৈয়দ গোলাম রহমান ও ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম । বড় বোনের বিয়ে হয় বানিয়াচঙ্গের কামালখানি হাসান মঞ্জিল নিবাসী মৌলভী সফিকুল হাসান সাহেবের সঙ্গে । প্রথম বোনের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বোনেরও উনার সঙ্গে বিয়ে হয় । তৃতীয় বোনের বিয়ে হয় লস্করপুর হাবিলি দেওয়ান সৈয়দ মাকসুদুর রেজা সাহেবের সঙ্গে,চতুর্থ বোনের বিয়ে হয় বানিয়াচং সাগরদিঘির পূর্বপাড় সৈয়দ বাড়িতে সৈয়দ আহমদ নবির সঙ্গে,পঞ্চম বোনের বিয়ে হয় চাচাতো ভাই মৌলানা সৈয়দ আবুল ফজল সাহেবের সঙ্গে । মৌলানা সৈয়দ আবুল ফজল দাওরায় হাদিস সনদ লাভ করেন । নিজ গ্রামের আলিয়া মাদ্রাসার সৈয়দ হোসাইন আহমেদ মাদানী সাহেবের উপদেশে মাদ্রাসা পরিচালনার কার্যভার গ্রহণ করেন । —————-।

লেখকঃ-সৈয়দ মোজাফফর ইমাম (সাজ্জাদ)

সৈয়দ গোলাম রহিম (ময়না মিয়া সাহেব) জীবন ও কর্ম

ডাক্তার সৈয়দ গোলাম রহিম নিজ বাড়ি মীরমহল্লা জামে মসজিদে মাঝে মধ্যে জুমার নামাজে ইমামতি করতেন । তিনি আজীবন মসজিদের মুতাওয়াল্লি ছিলেন । অসংখ্য লোক উনার মুরিদ ছিল । তিনি শেষ বয়সে মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতে শত শত মানুষ এসে ভীর জমাতো । তারা বাড়ির বাংলাঘর,মসজিদ ও বারান্দায় বসে উনার রোগমুক্তির জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করত । তিনি প্রায় ১১০ বৎসর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন । ১৯৯২ইং ১০ জুলাই রোজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তিনি নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) । উনাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় ।